সূচনা: বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে হিন্দু কলেজের 22 বছর বয়স্ক তরুণ শিক্ষক পর্তুগিজ বংশােদ্ভূত হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও এক অতি উল্লেখযোগ্য নাম। তার নেতৃত্বে কিছু আদর্শবাদী তরুণ হিন্দু ধর্ম ও সমাজের সকল শ্রদ্ধা হারিয়ে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণের মাধ্যমে দেশে এক চরমপন্থী মতাদর্শ প্রচার তে থাকেন। তারুণ্যের তেজে উদ্দীপ্ত এই আন্দোলনের ফলে হিন্দুধর্ম ও সমাজের ভিত্তি কেপে ওঠে। এই আন্দোলন নবজারণ আন্দোলন বা ইয়ংবেজ্গাল মুভমেন্ট নামে পরিচিত।
শিক্ষক ডিরোজিও: এই আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ডিরােজিও-র জন্ম ১৮০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার এন্টালি অঞ্চলে এক ইঙ্গ-পোর্তুগিজ পরিবারে কবি, যুক্তিবাদী ওস্বাধীন চিন্তার পূজারী ডেভিড ড্রামন্ড ধর্মতলা একাডেমিতে তিনি শিক্ষা লাভ করেন। ডিরোজিওর ওপর তার প্রভাবছিল অসামান্য। ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে (১৮২৮ খ্রি.) মাত্র সতেরাে বছর বয়সে তিনি হিন্দু কলেজ ইংরেজি ও ইতিহাসের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। তিনি ছিলেনউদীয়মান বাংলার এক প্রদীপ্ত প্রলয় শিখা। জাতীয়তার মন্ত্র গুরুরাজা রামমোহন ভারতীয় মহাযজ্ঞের সূচনা করেন, তিনি তাতে ঘৃতাহুতি দেন। যুক্তিবাদী ডিরোজিও বিনা বিচারে কিছুই মানতেন না এবং ছাত্রদেরও অন্ধবিশ্বাস ত্যাগ করে যুক্তিবাদি ও সত্যসন্ধানী হওয়ার পরামর্শ দিতেন। তিনি ছিলেন ছাত্রদের ডিরোজিও , বন্ধু ও পথপ্রদর্শক। তার চেষ্টায় ছাত্র লক, হিউম, বেকন,বার্কলে, রীড, টম পেইন, ভলতেয়ার, রুশো প্রমুখ দার্শনিক এবং ফরাসি বিপ্লবের চিন্তাধারারসঙ্গে পরিচিত হয়। সাধারণ অর্থে শ্রেণিকক্ষ বলতে আমরা যা বুঝি ডিরােজিও-র ক্লাস তা ছিল সেখানে সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, দেশপ্রেম—সব কিছু নিয়ে অবাধ আলােচনা চলত।এর উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তিবাদের উন্মেষ ঘটানো।
ডিরোজিওর জীবনী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
মতাদর্শ: ছাত্রদের মনে স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ঘটানাের উদ্দেশ্যে ১৮২৭খ্রিস্টাব্দে ডিরোজিও মানিকতলায় ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন' নামে এক বিতর্ক সভা।প্রতিষ্ঠা করেন। সম্ভবত এটিই ভারতের প্রথম ছাত্র সংগঠন। এখানে তার ছাত্ররা প্রচলিতঅর্থনৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করত।জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, প্রতিমা পূজা, সতীদাহ ও প্রচলিত হিন্দুধর্ম ছিল তাঁদের আকমণেরমূল লক্ষ্য(এথেনিয়াম ছিল এই সংঘের মুখপত্র। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা পার্থেনন নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এতে স্ত্রীশিক্ষা, নারী স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্বন্ধেপ্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ডিরোজিও-র উদ্যোগে প্রকাশিত (ক্যালেইডোস্কোপ' পত্রিকা ইংরেজশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। তারা হিন্দু ধর্মের রক্ষণশীল তাঁকে তীব্রভাবে আক্রমণকরেন। তাঁরা নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ করতেন, উপবীত ছিড়ে ফেলতেন, গঙ্গাজলের পবিত্রতা মানতেন না, ব্ৰায়ণ পুরােহিতদের লক্ষ্য করে বলতেন—“আমরা গােরু খাই গাে”, কালীঘাটের মন্দিরে মা কালীর উদ্দেশ্যে বলেন—::Good morning, Madam!" তার অনুগামীদের।হিন্দু ধর্ম অবলম্বী সব মতামত ও কার্যকলাপে হিন্দু সমাজে প্রবল আলোড়ন দেখা দেয়।ফলে তিনি হিন্দু কলেজ থেকে পদচ্যুত হন। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।
কার্যকলাপ: পাের্তুগিজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তিনি মনেপ্রাণে ভারতীয় ছিলেন। সম্ভবত ডিরােজিও-ই আধুনিক ভারতবর্ষের প্রথম জাতীয়তাবাদী কবি। তার রচিত“ফকির অব জঙ্গিরা’ ও ‘স্বদেশের প্রতি ('To My Country') কবিতায় দেশাত্মবােধ ফুটেউঠেছে। তিনি ও তার অনুগামীরা মাতৃভূমি ভারতবর্ষ গভীরভাবে ভালোবাসতে ভারতীয়সভ্যতা ও সংস্কৃতি একান্তভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। তাদের কালাপাহাড়ি মনোভাবেরজন্য দেশবাসীও তাঁদের গ্রহণ করেনি। ডিরােজিও-র মৃত্যুতে তার আদর্শ লুপ্ত হয়নি—তিনিস্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ইয়ং বেঙ্গল' নামে একদল অনুগামী রেখে যান
ডিরোজিওর জীবনী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
। ভারতীয় নবজাগরণেরইতিহাসে তাঁরা সকলেই বিশিষ্ট স্থানাধিকারী। তাঁদের মধ্যে কৃতি মোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র, রামতনু লাহিড়ী, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রসিককৃয় মপ্লিক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারা জ্ঞানান্বেষণ' ‘এনকোয়ারার ‘বেঙ্গল স্পেকটেটর ‘হিন্দ পাইওনিয়ার নামে পত্রিকা এবং সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা' নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা - করেন। রাজনৈতিক কার্য পরিচালনার জন্য ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা ‘বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি' প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরা খ্রিস্টান পাদ্রীদের গোঁড়ামি, স্ত্রী পুরুষের অ-সমানাধিকার, দাসপ্রথা, নারীর নির্যাতন, সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ বিধি, মরিশাসে ভারতীয় কুলি প্রেরণ, ভারতীয় বিচার ও পুলিশ ব্যবস্থা, বেগার খাটানো, একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকার, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং অন্যান্য সামাজিক, ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক কুসংস্কার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।
" ব্যর্থতা। এই আন্দোলনের ব্যর্থতার নানা কারণ ছিল। (১) তাঁদের কোনাে গঠনমূলক কর্মসূচি ছিল না তাদের সব চিন্তাধারাই ছিল নেতিবাচক। তাঁরা যে কী চান, তা-ই তাঁরা ঠিকমতাে জানতেন না। হিন্দুধর্ম বা পাশ্চাত্য সভ্যতা কোনােটি সম্পর্কেই তাঁদেরকোনো স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে সব কিছু না জেনেই তারা তার নিন্দায় সােচ্চার হয়েছিলেন। এর ফলে হিন্দু সমাজে ত্রাসের সঞ্চার হয়। এই আন্দোলনের পশ্চাতে কোনাে ছিল না। (২) এই আন্দোলন কিছু শহুরে তরুণ বুদ্ধিজীবী মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তারা বক্তৃতা ও পুস্তিকার মধ্যে তাদের আন্দোলন চালাতেন। দেশের সাধারণ মানুষের। সঙ্গে এর কোনাে সম্পর্ক ছিল না। ড. অনিল শীল-এর মতে, তাঁরা গজদন্ড মিনারে বাস "
মানুষের সমস্যাবলি সম্পর্কে তারা অবহিত ছিলেন না।চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন বা কুটিরশিল্প ধ্বংসের ফলে সৃষ্ট শোচনীয় আর্থিক দুর্দশা থেকে তাদের মুক্ত করার কোনাে পরিকল্পনা তারা গ্রহণ করেননি। (৪) মুসলিম সমাজের সঙ্গে এঁদের কোনাে সম্পর্ক ছিল না। (৫) ডিরোজিও-র মৃত্যুর পর প্রাথমিক উচ্ছাস স্তিমিত হলে তাদের অনেকেই চিরাচরিত। ঐতিহ্যের ক্রোড়ে আশ্রয় নেন। অনেকেই সরকারি চাকরি গ্রহণ করেন বা ব্যাবসায় মন দেন। হরচন্দ্র ঘোষ বাঁকুড়া সদর আমিন নিযুক্ত হন। গোবিন্দ চন্দ্র বসাক, রসিককৃষ্ণ মলিক ও । মাধব চন্দ্র মল্লিক ছিলেন ডেপুটি কালেক্টর। কিশোরী চাঁদ মিত্র ও শিবচন্দ্র দেব ছিলেন ডেপুটি। ম্যাজিস্ট্রেট। রাধানাথ শিকদার জরিপ দপ্তরে চাকরি নেন এবং হিমালয়ের উচ্চতা মেপে।বিখ্যাত হন। প্যারীচাঁদ মিত্র ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি-র সম্পাদক নিযুক্ত হন।দক্ষিণারন মুখোপাধ্যায় সরকার নানাভাবে সাহায্য করে অযোধ্যার তালুকদার পান এবং
১৮৭১-এ 'রাজা' উপাধি লাভ করেন।